খাইরুল ইসলাম, ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয়ী ঝালকাঠির শারমীন আজ বাংলাদেশের নারী সমাজের দৃষ্টান্ত। শারমীন এখন কাজ করতে চায় নারী শিক্ষার উন্নয়ন আর বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রে ‘সক্রেটোরি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ ২০১৭ এর আর্ন্তজাতিক পুরস্কারে ভূষতি বাংলাদেশের সেই সাহসী ছাত্রীর নাম শারমীন আক্তার।
এখনো সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। বয়স কম হলেও টুকু বুঝতে পারছিলাম, আমার ওপর যা হচ্ছে তা পুরোপুরি অন্যায়। আমার মায়ের ইচ্ছায়, পৃষ্ঠপোষকতায় সেই অন্যায় সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। একে তো আমার বিয়ের বয়স হয়নি। হঠাৎ মা একদিন বললেন, “এই ছেলে তোর স্বামী, এখন থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে ওর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে হবে তোকে!” নিছক কৌতুক করে তিনি এটা বলেননি। সত্যি সত্যিই বলেছিলেন। সে মতো কাজও করলেন। আমাকে ওই ছেলের সঙ্গে একটি ঘরে থাকার নির্দেশ দিলেন। এমনকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে আটকেও রাখলেন। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল।’ কথাগুলো শারমিন আক্তারের, যার বয়স মাত্র ১৪।
সে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী। ২০১৫ সালরে আগস্ট মাসে মাত্র ১৫ বছর বয়সে এক মধ্যবয়স্ক এ ব্যক্তির সাথে শারমীনের বিয়ে ঠিক করেন তার মা। যখন কথা হচ্ছিল শারমিনের সঙ্গে, তখন তার এই অভিজ্ঞতার কথা যেন থামে না। সে বলে, ‘আমি বিয়ের ব্যাপারে শুরুতেই মাকে না করে দিই। কিন্তু মা কিছুতেই এটা মানেননি বরং চাপ প্রয়োগ করেছেন। শারীরিক নির্যাতন করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাবা বিদেশে থাকেন। কার কাছে যাব, কী করব, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। একবার চিন্তা করি আত্মহনন করে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্ত হব।
আবার ভাবি, এটাও হবে হেরে যাওয়া।’ তাই এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে শারমিন। ‘সিদ্ধান্ত নিই, যে করেই হোক আমাকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। পড়ে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে এক সহপাঠীকে বিষয়টি জানাই। এরপর চলে যাই সরাসরি থানায়। মা আর ওই ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করি মা গোলেনুর বেগম ও বিয়ে করতে চাওয়া মধ্যবয়স্ক সেই ব্যক্তি স্বপন খানের বিরুদ্ধে। আটকে দেই নিজের বাল্যবিয়ে।’
পরে বিয়ষটি গণমাধ্যমে ব্যপক প্রচার পায়। আর তারই সূত্র ধরে এ বছরের ৩০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে ‘সক্রেটারি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ ২০১৭’ পুরস্কারে ভূষিত হয় শারমীন। ন্যায়বচিার, মানবাধকিার, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে ব্যতিক্রমী সাহসকিতা এবং জীবনের ঝুঁকি প্রর্দশন করায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ১৩ নারীর মধ্যে তাকে এ সম্মাননা দেয়া হয়। মার্কিন ফ্রাস্ট লেডি মেনালিয়া ট্রাম্প ও পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সক্রেটারি থমাস শ্যারনের হাত থেকে সে এ পুরস্কার গ্রহণ করেছিল।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার তুলাতলা গ্রামের সৌদি প্রবাসী কবির হোসেনের মেয়ে এবং রাজাপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শারমীন এখন পরীক্ষার ফল প্রত্যাশী। ঢাকায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখা পড়া করতে চায়। সে জানিয়েছে, এ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ায় তার ওপর দায়িত্ব এখন বেড়ে গেছে। লেখা পড়ার সাথে সাথে দেশের নারী শিক্ষার উন্নয়ন আর বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে সে কাজ করে যাবে।”
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই